নিজস্ব প্রতিবেদকঃ নারী,এই একটি শব্দেই নিহিত থাকে মমতা, সাহস, সহনশীলতা আর নতুন জীবনের সূচনা। পরিবার, সমাজ ও জাতি গঠনে নারীর অবদান অনস্বীকার্য হলেও দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে এখনও নারীর স্বাস্থ্য প্রতি সচেতনতা অত্যন্ত সীমিত। নারীদের নির্দিষ্ট কিছু রোগ, জটিলতা ও স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা রয়েছে, যেগুলোকে সময়মতো গুরুত্ব না দিলে ভবিষ্যতে তা হয়ে উঠতে পারে প্রাণঘাতী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর হাজার হাজার নারী স্তন ক্যান্সার, জরায়ু ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের জটিলতা কিংবা হরমোনজনিত নানা সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এসব রোগের অনেকগুলোই শুরুতে চুপিসারে শরীরে বাসা বাঁধে। প্রাথমিক উপসর্গকে অনেক সময় সাধারণ মনে করে অবহেলা করা হয়, যার ফলাফল হয় ভয়াবহ। যেমন স্তনে চাকা অনুভব করা, অনিয়মিত মাসিক, তলপেটে ব্যথা, হঠাৎ ওজন বেড়ে যাওয়া,অস্বাভাবিক স্রাব এসব লক্ষণকে হালকাভাবে নিলে রোগ জটিল রূপ নিতে পারে।
বর্তমানে শহর ও গ্রামে মেয়েদের মধ্যে যেসব সমস্যাগুলো বেশি দেখা যাচ্ছে তার মধ্যে পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম (পিসিওএস) অন্যতম। এটি একটি হরমোনজনিত সমস্যা যার ফলে মেয়েদের পিরিয়ড অনিয়মিত হয়, মুখে ও শরীরে অস্বাভাবিক লোম উঠতে পারে, ওজন বৃদ্ধি পায় এবং সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই সমস্যার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। তবে দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে এখনো এই বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা হয় না, ফলে অনেক মেয়েই নিজেকে গুটিয়ে ফেলে, দেরিতে চিকিৎসা নেয়।
নারীরা যখন বয়সের এক নির্দিষ্ট পর্যায়ে পৌঁছান, তখন মাসিক বন্ধ হয়ে যায়,যাকে বলা হয় মেনোপজ। এই সময় নারীর দেহে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ কমে যায়, ফলে দেখা দেয় হাড় ক্ষয়, ঘুমের ব্যাঘাত, ত্বক শুষ্ক হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং মানসিক বিষণ্নতা। এই সময়ে স্বামীর সহানুভূতি, পরিবারের মানসিক সহযোগিতা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনকভাবে আমাদের সমাজে অধিকাংশ নারী এসব পরিবর্তনকে ‘স্বাভাবিক বার্ধক্য’ মনে করে চিকিৎসা নেয় না।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো ইউটিআই বা মূত্রনালির সংক্রমণ, যা অনেক নারীর জীবনে বারবার ফিরে আসে। অপর্যাপ্ত পানি পান, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি না মানা এবং সময়মতো চিকিৎসা না নেওয়া এর অন্যতম কারণ। তাছাড়া সন্তান জন্মদানের পর অনেক নারীর প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, জরায়ু নামা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়, যেগুলো অনেক সময় অপারেশনের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য হলেও লোকলজ্জার ভয়ে অনেক নারী চিকিৎসা নেন না।
নারী স্বাস্থ্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মানসিক স্বাস্থ্য। গৃহস্থালি কাজের চাপ, পারিবারিক নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রের বৈষম্য ও অবমূল্যায়ন নারীদের মধ্যে ডিপ্রেশন, উদ্বেগ ও আত্মবিশ্বাস হারানোর মতো সমস্যার জন্ম দেয়। বিশেষ করে গৃহিণীরা অনেক সময় নিজেদের সমস্যাকে গুরুত্ব দেন না, যা দীর্ঘমেয়াদে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য দরকার সামগ্রিক সামাজিক সচেতনতা। পরিবারে ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শরীর সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা দেওয়া, বিদ্যালয়ে স্বাস্থ্যশিক্ষার পাঠ অন্তর্ভুক্ত করা এবং গণমাধ্যমে খোলামেলা আলোচনার সুযোগ তৈরি করা জরুরি। তাছাড়া নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, প্রাথমিক উপসর্গগুলো সম্পর্কে সচেতনতা এবং চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া নারীর সুস্থ জীবনের পথে বড় পদক্ষেপ।
নারী শুধুমাত্র একটি পরিবার নয়, একটি জাতির ভিত্তি। তার স্বাস্থ্য নিশ্চিত করলেই একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে ওঠে। নারী রোগকে গোপন করা নয়, এখন সময় এসেছে তা নিয়ে খোলামেলা কথা বলার, বুঝে নেওয়ার এবং যথাসময়ে সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করার।