- নিজস্ব প্রতিবেদকঃ বাংলাদেশের কৃষি খাত বহুদিন ধরে দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে বিবেচিত। ধান, গম, পাট, আলু বা ভুট্টার মতো প্রধান শস্যগুলোর বাইরেও আছে আরেকটি সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র,হর্টিকালচার বা উদ্যানতত্ত্ব। বর্তমানে এটি শুধুমাত্র একটি কৃষি শাখা নয়, বরং দেশের পুষ্টি, খাদ্য নিরাপত্তা, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে।
হর্টিকালচার (Horticulture) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ hortus অর্থাৎ বাগান এবং cultura অর্থাৎ চাষ থেকে। সহজভাবে বললে, ফলমূল, শাকসবজি, ফুল, মসলা, চা-কফি, এবং অলংকারমূলক গাছপালা চাষ ও ব্যবস্থাপনার বিজ্ঞানই হলো হর্টিকালচার। এটি শুধুমাত্র খাবার চাহিদা পূরণে নয়, সৌন্দর্যবোধ, পরিবেশ রক্ষা, ঔষধি গাছের সংরক্ষণ এবং ব্যবসায়িক সফলতার মাধ্যম হিসেবেও বিবেচিত।
বাংলাদেশে বর্তমানে হর্টিকালচার খাতটি দ্রুত বিকাশমান। দেশে প্রায় ১.৩ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে ফল ও সবজির চাষ হয়। আমাদের দেশে উৎপাদিত শস্যের মধ্যে প্রায় ২০-২৫ শতাংশ এই খাতের আওতাভুক্ত। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, নরসিংদী, সাতক্ষীরা, বান্দরবান, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন অঞ্চলে স্থানীয় জলবায়ুর উপযোগী করে নানা জাতের ফল-ফুল ও সবজি বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ফল-সবজি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে অন্যতম। আমাদের দেশের আম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা, কলা, নারকেল, পেঁপে,এসব ফল এখন শুধু দেশের বাজারেই নয়, বিদেশেও যাচ্ছে। একদিকে পুষ্টির ঘাটতি কমছে, অন্যদিকে রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
ফল ও সবজি হচ্ছে ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের প্রধান উৎস। দেশের জনগণের স্বাস্থ্য সচেতনতাও এখন অনেক বেড়েছে। ফলে খাদ্য তালিকায় ফল ও সবজির চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। নার্সারি ব্যবসা, ছাদ কৃষি, ফুলচাষ, মাইক্রোগ্রীনস বা হাইড্রোপনিক্স,সব কিছু মিলিয়ে এখন অনেক তরুণ উদ্যোক্তা এই খাতে এগিয়ে আসছেন। কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহারে যেমন মোবাইল অ্যাপ, আইওটি, স্মার্ট গ্রিনহাউস ইত্যাদিও জনপ্রিয় হচ্ছে। ফুল, ফল ও সবজি চাষে রাসায়নিকের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে কম। এতে মাটির উর্বরতা রক্ষা পায় এবং বায়ুদূষণও কম হয়। শহরে ছাদ কৃষি বা ওয়ার্ম ফার্মিংয়ের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করা সম্ভব। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, পেঁপে, লাউ, ধনেপাতা, মরিচ, আদা, পেঁয়াজপাতা এসব হর্টিকালচারাল পণ্য ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। চাহিদা আরও বাড়ছে।
তবে সম্ভাবনার পাশাপাশি হর্টিকালচার খাতের কিছু সীমাবদ্ধতা এখনো রয়েছে। যেমন পর্যাপ্ত হিমাগার ও সংরক্ষণ সুবিধার অভাব, ফলে অনেক পচনশীল ফল ও সবজি নষ্ট হয়ে যায়। বাজার ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, কৃষকরা ন্যায্য দাম পান না। মধ্যস্বত্বভোগীরা বেশি লাভ করে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও দেখা দিচ্ছে,খরার সময় পানি সংকট, অতিবৃষ্টিতে গাছ নষ্ট হওয়া,এসব সমস্যা চাষকে অনিশ্চিত করে তোলে। অধিকাংশ কৃষক এখনো স্থানীয় জ্ঞান ও পুরনো পদ্ধতিতেই নির্ভরশীল, প্রযুক্তির স্বল্প ব্যবহারে উৎপাদনশীলতা ও মান কমে যায়।
সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ হর্টিকালচার সেন্টারগুলো বর্তমানে উন্নত জাতের চারা, আধুনিক প্রশিক্ষণ, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে তোলা, মাঠপর্যায়ে পরামর্শ প্রদান ও কৃষি প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানও হর্টিকালচার নিয়ে শিক্ষাদান ও গবেষণায় এগিয়ে আসছে।
হর্টিকালচারের এই অগ্রযাত্রায় যুবসমাজ ও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, নতুন প্রযুক্তির সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, পণ্য সংরক্ষণ ও রপ্তানির সুযোগ বৃদ্ধি করা এবং কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। শুধু উৎপাদন বাড়িয়ে নয়, মানসম্পন্ন উৎপাদন, বুদ্ধিমত্তাপূর্ণ বিপণন ও রপ্তানিমুখী পরিকল্পনার মাধ্যমেই বাংলাদেশ হর্টিকালচারে বিশ্বদরবারে নিজের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পারবে।
পরিশেষে বলা যায়, হর্টিকালচার এখন আর শুধু কৃষকের জমিতে সীমাবদ্ধ নেই। এটি হয়ে উঠছে একটি আধুনিক, পরিবেশবান্ধব ও লাভজনক পেশা। বাংলাদেশের মতো সম্ভাবনাময় ভূখণ্ডে হর্টিকালচারের বিকাশের মধ্যেই লুকিয়ে আছে একটি স্বাস্থ্যসম্মত, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও উন্নত ভবিষ্যতের চাবিকাঠি।